তিন
আপনি তো বাজারে চলে গেলেন, এদিকে ছেলে আবার চোখ উলটোয় পড়িছিল।
তারক ডাক্তার স্টেথো দিয়ে রোগির বুক-পিঠ ছেনে যথারীতি বাঁহাতে তার কবজি ধ’রে নিজের রিস্টওয়চে ডুবে গেছে। আর দিদিমার বুক ঢিপ ঢিপ, তারক সেই উদ্ভুট্টি কথাটা ব’লে বসবে না তো — ঘ্যাঁজ্ড়া?
জর্দাপানের গন্ধলাগা পুরিয়া নির্মলের হাতে ধরিয়ে ডাক্তার চলে গেল। তা থেকে এইটুকুন হাফ ট্যাবলেট “ওঁ বিষ্ণু ওঁ বিষ্ণু” ক’রে খাইয়ে দিতেই গায়ে নড়াচড়া লেগে চাঁদের হাঁচি পড়ল একটা। নির্মল বলল, জীব!
কাহিল গলা শ্বাস টানতে টানতে জিগ্যেস করে :
— জীবো মানে কী?
— মানে জীব সহস্রং, হাজার বছর বেঁচে থাকো।
— কেউ হাঁচি দিলি আপনি বাঁচতি বলেন কেন?
উত্তর নেই। আলাম্-ফালাম্ কথা না ক’য়ে চোখ বুজে এট্টু শুয়ে থাক, বলে মায়া রান্নাঘরে পা বাড়ায়। ছেলে চোখে পলক টেনে দেয়, কিন্তু ভ্রূ কুঞ্চিত থাকে।
মায়ার পড়াশুনো প্রাইমারি স্কুলের চার কেলাস; ওই জ্ঞানবলে সে যে-কোনও বাংলা বই সগৌরবে পড়ে ফেলতে এবং পরিচ্ছন্ন চিঠি লিখতে পারে। তার ওপর শ্রুতি-বিদ্যেয় মহিলার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া মুশকিল — বড় বড় রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন দত্ত বা কুসুমকুমারী ভাতের মাড় গালতে গালতেও টর-টরিয়ে ব’লে যাবে।
শুধু সেলাইফোঁড়াইটা বিশেষ আসে না ব’লে মায়ের ঠেলা খেয়ে জন্মের-মধ্যে-কর্ম একখানাই কুরুশকাঠির আসন বানিয়েছিল। সেটা বড়ঘরের দেওয়ালে ঝুলছে — মুখোমুখি দুই সুতোর ময়ূর আর লেজের নীচে “বেদনার সাধনায় যে জন নির্ভয়, আজ হোক কাল হোক জয় তার জয়”। বর্গীয় জ-এর মাকড়ি কাঁচা হাতের টানে আ-কার হয়ে যাওয়ায় সঞ্জু প্রায়ই তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে পড়ে — বেদনার সাধনায় যে ডান নির্ভয়, আডা হোক কাল হোক ডায় তার ডায়। ছেলে তো না, এট্টি পাকা কলা!
শোনা-বিদ্যেয় ধুরন্ধর মায়া জানত, অথর্ব বেদে বলা আছে — কেউ হাঁচি দিলে ওমনি জীব সহস্রং উচ্চারণ ক’রো, কেননা হঞ্ছিকাকালে মানুষ মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যায়। বাবা সে-কথা ভাঙতে চায়নি অসুস্থ ছেলের কাছে।
চার
— বন্ধুগণ, আগামি কাল সন্ধ্যা ছ’ঘটিকায়… আসুন দেখুন… দশরথ কেঁদে কেঁদে অন্ধ, ভরত শোকে পাথর… মা ইচ্ছাময়ী অপেরার পরিচালনায়… ধনীর দুলালি সীতা আজি পথের ভিখারি…কলোনির সমস্ত অধিবাসীবৃন্দের অনুরোধে… আরও এক সপ্তাহ বাড়ানো হল… রামের বনবাস, রামের বনবাস, রামের বনবাস।
মুখের সামনে খবরের কাগজের চোঙা ধ’রে ক্ষয়াটে চেহারার একজন ভ্যানরিকশায় যেতে যেতে চেঁচাচ্ছে। যেখানে দু’চারটে বাড়ি বা রাস্তার তেমাথা, সজনেগাছের গায়ে বিজ্ঞাপনের কাগজ চিটিয়ে দিচ্ছে লোকটা। তারপর ভ্যানের পেছনে ছোটা বাচ্চাদের একটা পোস্টারের জন্যে আবেদন অগ্রাহ্য ক’রে :
— একই সন্ধ্যায় রূপসী সীতা ও রাক্ষসী শূর্পনখা… সকলের বসিবার সুবন্দোবস্ত… হ্যাজাকের আলোয় দেখুন এই প্রথম গ্রামের মঞ্চে সোনার হরিণ… তাছাড়া ফুলুটে মালতীপুরের খলিফা শিল্পী স্বদেশ পাল… পালা শেষে মুক্ত হস্তে মালা-ডাকের সুযুগ আছে…।
— দিদ্মা, আমি রামযাত্রা দেখতি যাবো।
— যাবাই তো। বুকির কষ্ট এট্টু কি কোমিছে, দাদাভাই?
চাঁদ সোয়েটারের ওপর দিয়ে গলার অস্থি এমন আলতো ছোঁয়, যেন সাত দিনের বাসি গোলাপ, দোকা লাগলেই পাপড়ি ঝরে যাবে। তারপর দুবার নিঃশ্বাস টেনে চোখ বড় ক’রে বলে, ব্যথা লাগতিছে না! ঝুপড়ি ভেঙে রাস্তা পাকা করার মতো তার বুকের খাঁচার মধ্যে ফুসফুস হৃদপিণ্ড সব উড়িয়ে দিয়ে শুধু একটা তেলমাখা ঝাঁ-ঝাঁ করা ন্যাশানাল হাইওয়ে, যার ওপর বাতাসের অনন্তপ্রসূন শুধু ফুটেই চলেছে… কড়াইতে উচ্ছ্বসিত খইয়ের মতো। দিদিমা নিজের কপালে যুক্তকর তুলে আনে — জয় মা বিপত্তারিণী! তারকের ওষুদি কথা কয়! তখন বাসু বুড়ির কাঁধ জড়িয়ে ধ’রে ফিসফিসিয়ে জানাচ্ছে, ওষুধে কথা কোতি পারে, কিন্তু জানো, যে হাতঘড়িতি ডাক্তারবাবু রুগির নাড়ি পরীক্ষে করে, সেটা ডাহা অচল; সকালবেলা আড়াইটে বাজে ব’সে আছে। মা সরস্বতীর দিব্যি!
পাঁচ
— আমার চোখের দিকি তাকায় বল, রান্নাঘরে ঢুকে তালের ফোপ্ড়া খাইছিস?
চার ভাইবোন দাঁড়িয়ে, মা এক এক ক’রে জেরা করছে। যে হেসে দেবে, সে চোর।
— ভাইয়ের জ্বর ব’লে তার ভাগেরটা রাখে দিছিলাম, সেও গিলতি হ’লো!
আজ শিউলি হেসেছে, কিন্তু কথায় কথায় ফুটফুটে দাঁত দেখায় ব’লেই না সে শিউলি। সঞ্জুকে যেমন “ঘুর ঘুর স্ট্যাচু” খেলাতেও হাসানো যায় না, তার মানে সে সাধুপুরুষ? মা বিরক্ত হয়ে চার বাচ্চাকেই চড়াচ্ছে।
তারপর — বাসু, আমতলাত্থে আমের ডালটা উঠোনে নিয়ে থো, বাবা কুড়োল দিয়ে ফাড়ে দেবেনে। কয়লা ফুরোয় গেছে — ব’লে মায়া চাঁদের কপালে গাল ঠেকিয়ে জ্বর আছে কিনা দ্যাখে।
বাসু ওমনি মারধর ভুলে ভারি আমডালের এক দিক উঁচু করে “মাগো আমার দে না কেন একটি ছোটো ভাই” বলতে বলতে খানিকটা ছেঁচড়ে আনল, দম নিয়ে “দুইজনেতে মিলে আমরা বনে চলে যাই” ব’লে আরও খানিকটা। এভাবে কবিতা ফুরোতে ফুরোতে কাজও শেষ। কিন্তু আরও একটা ছোটো ভাইয়ের শখ নাকি বাসুর? আপ্নি শুতি ঠাঁই পায় না, শংকরারে ডাকে!
রান্নাঘরের উঁকি মেরে গোপা দেখল, মা ঠোঁটে হাসি চেপে জ্বাল দেওয়া দুধ একটা কাপে ঢালছে। ঘর জুড়ে যেন শিশুর মুখের গন্ধ…।
— মা, আমার পেটে কিচ্ছু নেই!
— সে কি, অ্যাক্খুনি চিঁড়ে দিয়ে কলা দিয়ে খালি যে?
— আমার দুধির ক্ষিদে পাইছে।
মায়া প্রথমে চোখ পাকায়, তারপর হাতছানি দিয়ে মেয়েকে ডাকে, ডেকচি থেকে দু’হাতা দুধ ব’ক্নো থালায় ঢেলে ফুঁ দিয়ে হাতে ধরিয়ে ভর্ৎসনা করে : সব দৃষ্টিক্ষিদে। মুখ পুড়োস না। খায়ে চুপ ক’রে বেরোয় যাও।… আগে ঠোঁট মোছ, ঠোঁট মোছ!
ছয়
কাপের দুধে চুমুক দিতে দিতে কাঁথা-গায়ে চাঁদ জানলার ফোকর দিয়ে রাস্তা দেখছিল। সুপুরিগাছের শুকনো খোলার ওপর একটা কচি বাচ্চাকে বসিয়ে তিনটে খুদে টানছে। হ্যাঁচকা টান খেয়ে সে পেছনে উলটে প’ড়ে অপরিমেয় কাঁদতে লাগল। একটা ছেলে চলে গেল চটপটি বাজাতে বাজাতে। মনিদাও খুব সুন্দর চটপটি বানায় — কলাপাতার মোটা ডাঁটি এক-হাত মতো কেটে নিয়ে তার এক মাথা দা দিয়ে লম্বালম্বি তিন ভাগে চিরে দুপাশের ফালিদুটোর গোড়া একটু ভেঙে নিতে হবে। এবার ডাঁটির আর এক মাথা ধ’রে ঘন্টা বাজানোর মতো নাড়লেই চটপট চটপট…। এইসব লোক-চলাচলের ফাঁকে দেখা যাচ্ছে রাস্তার ওপিঠে চন্ডীবাবুদের জমিতে গেঞ্জি আর লুঙি পরা মানুষটাকে; দুটো ইঁটের ওপর ব’সে সামনের দুটো ইঁটে পা বিছিয়ে দু’পায়ের পাতার মাঝখানে ঝামা ইঁট রেখে হাতুড়ি চালাচ্ছে। তিনবার চারবার বাড়ি খেয়ে ইঁট শোকে পাথর না থেকে ভেঙে পড়ছে, হয়ে যাচ্ছে খোয়া।
এমনি ক’রে আস্তে আস্তে ছোট্ট খোয়াটিলা তৈরি হচ্ছিল আর লোকটাও ভেসে উঠছিল টিলার মাথায়… মাটি থেকে তার দূরত্ব বাড়ছে ধিকিধিকি। প্রত্যেকবার হাতুড়ির ঘায়ের সঙ্গে হ্যাহ্ নামের একটা গোঙানি বা গর্জন মিশিয়ে দিচ্ছে আর চাঁদের কানে সেই শব্দজোড় পৌঁছোচ্ছে হাতুড়ি ইঁটে পড়ার ভগ্ন-মুহূর্ত পরে। এভাবে সকালে যে ভূমিপুত্র, দুপুরে ভাত খেয়ে এসে তুমি দেখলে কিছুটা পাহাড়ি, আর বিকেলে খেলতে বেরোনোর সময়ে সে গোঁফেগেঞ্জিতে লাল সুরকি লাগা খোয়া-হিমালয়ের ঈশ্বর, শান্তিমতো একটা বিড়ি ধরাচ্ছে। ওদিকে রাস্তার ধারে কোনও বাচ্চা উবু হয়ে বসল, ন্যাংটো পাছার নীচে হলুদ ধোঁয়া-ওঠা অজগর-পাক, শেষে ছুঁচোলো ফনাটা। জানলায় মাজালি বিড়বিড় ক’রে চরে বেড়ায়, এখন রোদ্দুর গোধূমবর্ণ ত্যাগ ক’রে অল্প অল্প চাঁটি মেরে আমাদের পিঠ গরম করার উপযুক্ত। সেই অনবরত ধূপছাঁওয়ের মধ্যে একটা ঝিমধরা খট খট আওয়াজ শোনা গেল। পদপাতহীন কেঠো পা নিয়ে চাঁদের আমতলাবাড়ির পাশ দিয়ে বিজুখোঁড়া দুলে দুলে হেঁটে যাচ্ছে স্টেশানের দিকে।
(আর একটু)
loading...
loading...
দ্বিতীয় খণ্ডাংশ পাঠের অপার মুগ্ধতা জানিয়ে গেলাম প্রিয় কবি চন্দন ভট্টাচার্য দা।
loading...